সন্তান প্রসবের পর মাসুকা কক্সবাজারের কুতুপালংয়ের সরকার পরিচালিত একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিছানায় শুয়ে আছেন। এই প্রথম সন্তান জন্ম দিলেন তিনি, তাঁর মুখ তখনো মলিন। মাসুকার শ্বাশুড়ি আর স্বামী পরিবারে নতুন সদস্য পেয়ে খুবই খুশি। একসময় তাঁরা নবজাতককে মায়ের পাশে এনে শুইয়ে দিলেন। সন্তানের মুখ দেখে মাসুকার ম্লান মুখটা তখন উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সন্তান পেয়ে স্বভাবতই খুব খুশি ২৪ বছরের মাসুকা। তিনি বলছিলেন, কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই তাঁর সন্তান হয়েছে। এখানকার সেবা পেয়ে তিনি খুবই বিস্মিত।
শিশুটির এখনো নাম দেওয়া হয়নি। মাসুকা স্বামী শাফি আলম বলছিলেন, নাম ঠিক করার মতো চিন্তা করার সময় তিনি পাননি। তাঁরা রাখাইন রাজ্যের মংডু জেলার ধানখালি গ্রাম থেকে পালিয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে এসেছেন। এই অল্প সময়ে বেঁচে থাকার জন্য এতো বেশি লড়াই করতে হয়েছে যে, শিশুটির নাম রাখার চিন্তা মাথায় আসেনি।
রোহিঙ্গারা শত শত বছর ধরে রাখাইন রাজ্যে বসবাস করলেও তাঁরা যুগের পর যুগ ধরে মিয়ানমার রাষ্ট্রের নিগ্রহের শিকার। সম্প্রতি সেনা ও পুলিশ ক্যাম্পে ‘বিদ্রোহীদের হামলার’ পর রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নতুন করে হামলা-নির্যাতন-ধর্ষণ শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। আর এতে তাদের সহযোগিতা করছে উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী ও মগরা।
জাতিসংঘ একে ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদী উদাহরণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। প্রায় চার লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী কক্সবাজার জেলায় আশ্রয় নিয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিম পুরুষদের ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করছে, নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম তাঁরা জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী উপকূলবর্তী এলাকায় আস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় পেয়েছেন। সরকার, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা তাদের খাদ্য, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক তহবিলের (ইউএনএফপিএ) দেওয়া হিসেব মতে, রাখাইন রাজ্য থেকে আসা রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে প্রায় দেড় লাখ প্রজননক্ষম; যাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৯ এর মধ্যে। এর মধ্যে ২৪ হাজার নারী এসেছেন যারা সন্তানসম্ভবা বা প্রসূতি। তাঁরা এসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে সহায়তা পাচ্ছেন।
নারীদের সেবা দিতে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে কাজ করছেন ধাত্রীরা। ইউএনএফপিএ ধাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাদের একজন তানিয়া আক্তার। তিনি গত ফেব্রুয়ারিতে কুতুপালং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যোগ দিয়েছেন। তিনি জানালেন, অনেক রোহিঙ্গা নারীই অসুস্থ অবস্থায় তাদের এখানে আসছেন। গত ২১ দিনে এই কেন্দ্রে ১২ জন নারী সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এখানে যেসব রোহিঙ্গা নারী সন্তান জন্ম দিতে আসছেন, তাদের অনেকেই অভূক্ত। তাদের প্রয়োজনীয় কাপড় নেই, কিছু কেনার মতো পয়সাও নেই। সত্যিকার অর্থেই তাঁরা খুব অসহায়, অনেকে রাস্তার পাশে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
আরেফা বেগম নয় মাসের গর্ভবতী। কিন্তু মৃত্যুর মুখ থেকে পালাতে তাঁকে দৌড়ে আসতে হয়েছে। তিনি মংডু জেলার বলিবাজার থেকে কক্সবাজারে এসেছেন সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ।
আরেফা বেগম বলেন, ‘আমি এই অবস্থায় মাইলের পর মাইল হেঁটেছি। কোনো বিশ্রাম নেইনি। আমার কোনো খাবার ছিল না, এর মধ্যে বৃষ্টি পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছিল। আমি প্রচণ্ড ক্লান্ত ছিলাম, কিন্তু শ্বাস নেওয়ার মতো অবস্থাও ছিল না।’
‘মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে নিজেকে নিরাপদ ভাবার মতো অবস্থা আর নেই। এর চেয়ে এখানেই ভাল আছি’, যোগ করেন আরেফা। তিনি আরো বলেন, ‘মিয়ানমারে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি এখানে আছি, এটাই শুকরিয়া।’ আরেফার স্বামীর নাম সিরাজুল মোস্তফা। অর্থের সঙ্কাট থাকার পরেও এমন সেবায় তিনি খুশি।
স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের আরেক ধাত্রী নাজমা আক্তার (২৪) জানান, এখানে ওষুধসহ যাবতীয় সেবা বিনা পয়সায় দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের লোকেরা শারণার্থী শিবিরে গিয়ে গর্ভবতী নারীদের সচেতন করেন এবং নিরাপদ প্রসবের জন্য এখানে আসার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। এখানে সাধারণ রোগী, বয়স্ক ও শিশুদেরও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
নাজমা বলেন, ‘শরণার্থী শিবিরের নারীরা পুষ্টিহীনতা ও রক্তশূন্যতায় ভুগছেন। এর আগে তাদের স্বাস্থ্যসেবার কোনো সুযোগ ছিল না।’
২০ বছরের আশুরা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে এসেছেন নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য। মাত্র ছয় দিন আগে তিনি সন্তান জন্ম দিয়েছেন। তিনি এখন ব্যথা ও মাথায় ঘুরানোতে ভুগছেন। তিনি জানান, তাঁর বাড়ি মংডুর সাবরাগুনা গ্রামে। কিন্তু এখানকার মতো স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সেখানে ছিল না। এখানকার চিকিৎসায় আশুরা খুশি।
ইউএনএফপিএর চিকিৎসক ডা. আশরাফুল আলম জানান, তাঁর সংস্থার অধীনে কুতুপালংসহ কক্সবাজারের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ৬৮ জন ধাত্রী কাজ করেন। এই মুহূর্তে চারটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র চলছে, আরো চারটা শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ইউএনএফপিএর মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা প্রিয়া মারওয়াহ জানান, এসব কেন্দ্রের বাইরে তাদের মোবাইল ক্লিনিকও রয়েছে। এ ছাড়া আরো অনেকেই স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘দুই দিন আগে একজন নারীকে পাওয়া গেছে, যিনি মধ্যরাতে রাস্তার পাশে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। পরে তাঁকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। ধাত্রীরা তাঁকে ও তাঁর সন্তানকে সেবা দিচ্ছে। এটা এখন প্রতিদিনকার ঘটনা।’
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আরেক ধাত্রী তানিয়া জানালেন, রোহিঙ্গা নারীরা অনেক বেশি দুর্বল। কারণ, তাদের অনেক সন্তান।
‘আমরা এমন অনেক মাকে পেয়েছি যাদের সাতটা থেকে ১৪টা পর্যন্ত সন্তান আছে। এর কারণ, তাদের পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। এখন আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি, তাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করছি’, যোগ করেন ধাত্রী তানিয়া।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন